চর্যাপদ, মূল পদ, অর্থ ও ব্যুৎপত্তি, গদ্যরূপ, প্রশ্ন উত্তর
চর্যা-১
লুই পা
রাগ পটমঞ্জরী
কাআ তরুবর পঞ্চবি ডাল।
চঞ্চল চীএ পইঠো কাল ।। ধ্রু।।
দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ।
লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জাণ।। ধ্রু।।
সঅল সমাহিঅ কাহি করিঅই।
সুখ দুখেতেঁ নিচিত মরিআই।। ধ্রু।।
এড়িএউ ছান্দক বান্ধ করণক পাটের আস ।
সুনুপাখ ভিড়ি লাহু রে পাস।। ধ্রু।।
ভণই লুই আমহে সানে দিঠা।
ধমণ চমণ বেণি পান্ডি বইঠা।। ধ্রু।।
অর্থ ও তাৎপর্য
পঞ্চবি ডাল:- বৌদ্ধ পঞ্চস্কন্ধ হল পঞ্চবি ডাল।রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান এই পাঁচটিকে বলা হয় পঞ্চমী ডাল।
চঞ্চল চীএ:- চঞ্চল চিত্ত। আমাদের মন প্রকৃতি আভাস দোষে চঞ্চল । মনের এই অবস্থা থেকে আমাদের কালবোধ জন্মে এবং তা থেকে সংসার জ্ঞানের উৎপত্তি হয়।
কাল:- সংসার জ্ঞান
মহাসুহ:- মহাসুখ। বিষয়ের প্রতি আসক্তি ও সংসারের প্রতি মোহকে অতিক্রম করে সহজানন্দ লাভ।
ভণই:- ভনিতা > ভণই
পুচ্ছিঅ:- জানো
সঅল :- সকল
সমাহিঅ:- ধ্যানে নিমগ্ন হওয়া।
নিচিত:- নিশ্চিত / অবশ্যই
ছান্দক:- বাসনার
করণের:- ইন্দ্রিয়ের
পাটের:- পরিপাট্টের
সুনু:- শূন্য
পাখ:- পাখা
ধমন চমন :- ইড়া এবং পিঙ্গলা নামক দুই নাড়ী।
পিন্ডি :- পিঁড়ি।
গদ্যরূপ
দেহগাছের পাঁচটি ডাল। চঞ্চল চিত্তে কাল প্রবেশ করেছে। দৃঢ় করে মহাসুখ লাভ কর। লুই বলেন, গুরুকে জিজ্ঞাসা করে জানো। সকল সমাধিতে (ধ্যানে) কি করে ? সুখ দুঃখেতে নিশ্চয় মরে। ছন্দের (বাসনার) বন্ধন ও করণের ( ইন্দ্রিয়ের) পারিপাট্টের আশা ত্যাগ কর। শূন্য পাখার দিকে দৃষ্টি দাও। লুই ভনে আমি ধ্যানে দেখেছি।ধমন চমন যুগ্ম পিঁড়িতে আমি বসেছি।
সংক্ষিপ্ত কিছু প্রশ্ন
১। চর্যার প্রথম পদটি কার লেখা ?
উঃ- লুই পা
২। চর্যাগীতির প্রথম পদটি কোন রাগে গাওয়া হয় ?
উঃ- পটমঞ্জরী।
৩।
বড়ো প্রশ্ন ও তার উত্তর
১। চর্যাপদের প্রথম পদটির গূঢ়তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর।
উঃ - বাংলা সাহিত্যের আদি যুগের একমাত্র প্রামাণ্য নিদর্শন চর্চা গীতির প্রথম পদটির রচয়িতা হলেন লুইপা। এই পদটিতে বৌদ্ধ সহজিয়া সাধন পদ্ধতি ছাড়াও সাধকদের দার্শনিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষভাবে প্রাধান্য পেয়েছে। পদকর্তা লুই পা বলেছেন আমাদের এই দেহ হল পঞ্চ ডাল বিশিষ্ট তরুর মত তা রূপ,বেদনা , সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান এই পঞ্চকায়ের সমন্বয়ে গঠিত। আমাদের মন প্রকৃতি-আভাষ দোষে নিয়ত চঞ্চল, মনের এই চঞ্চল অবস্থা থেকেই আমাদের কালবোধ জন্মে, এবং তা থেকেই সংসার জ্ঞানের উৎপত্তি হয় । এই চঞ্চল মনকে নিঃস্ব ভূমিকৃত করতে হলে তাকে করতে হবে। তার জন্য অবশ্যই গুরুর নির্দেশ গ্রহণ করা প্রয়োজন। ধ্যান সমাধির দ্বারা কিছুই লাভ হয় না, এর দ্বারা সংসারের সুখ-দুঃখ ভোগ করতে হয়। অতএব সংসারের বাসনার বন্ধন বা ইন্দ্রিয়ের পরিপাট্যের আসা পরিত্যাগ করে শূন্যতার পক্ষ অবলম্বন করতে হবে। শুধু প্রবৃত্তিমূলক ভববোধে সহজানন্দ নেই আবার শুধু শূন্যতাতেও সুখ নেই। এই দুইয়ের অন্বয় সামরস্যেই সহজানন্দ রূপ সুখের উপলব্ধি। পদের শেষ অংশে লুই পা বলেছেন ধমন অর্থাৎ ইরা এবং চমন অর্থাৎ পিঙ্গলা এই দুই নাড়ীকে সুষুম্না কান্ডের নিচে অবস্থিত শক্তিতে মিলিয়ে, সুষুম্নাপথে মস্তিষ্কের সঙ্গে মিলন ঘটালেই সহদানন্দ অনুভূত হয়।
চর্যাপদের টীকাকার মুনি দত্ত এই পদটিকে মহারাগনয়চর্যা পদ্ধতির রূপে উল্লেখ করেছেন । বৌদ্ধ সহজ সাধনার পদ্ধতিগত ইঙ্গিত থাকাতেই মনে করা হয় তিনি এরূপ নামকরণ করেছিলেন।
0 Comments